রবিবার ১৯ মে ২০২৪
Online Edition

ভাষা আন্দোলন এবং হিন্দির আগ্রাসন 

আবারও এসেছে একুশে ফেব্রুয়ারি, মহান শহীদ দিবস। ১৯৫২ সালের এই দিনে বাংলাকে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা হিসেবে প্রতিষ্ঠার আন্দোলনে সালাম, রফিক, জব্বার ও বরকতসহ ভাষা সংগ্রামীরা প্রাণ উৎসর্গ করেছিলেন। তাদের সে আত্মত্যাগ ও সংগ্রামের পথ বেয়ে বাংলাই শুধু রাষ্ট্রভাষার অবস্থান ও মর্যাদা অর্জন করেনি, পর্যায়ক্রমিক আন্দোলনের মধ্য দিয়ে স্বাধীন রাষ্ট্র বাংলাদেশও প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। পরবর্তীকালে একুশে ফেব্রুয়ারিও পেয়েছে ‘আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসের’ অনন্য মর্যাদা। জাতিসংঘের সিদ্ধান্ত অনুসারে ২০০০ সাল থেকে দিনটিকে বিশ্বের সকল দেশেই ‘আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস’ হিসেবে পালন করা হয়। বাংলাদেশের ভাষা শহীদদের সংগ্রাম ও অবদানের কথা স্মরণ করে বিশ্ববাসী। এর কারণ, বিশ্বের বিভিন্ন দেশ ও অঞ্চলে প্রায় ছয় হাজার ভাষা রয়েছে। কিন্তু মাতৃভাষার স্বীকৃতি আদায় ও মর্যাদা প্রতিষ্ঠার জন্য বাংলাদেশের ছাত্র-জনতাই কেবল সংগ্রাম করেছেন, শরীরের রক্ত ঝরিয়েছেন এবং প্রাণ পর্যন্ত দিয়েছেন। আর কোনো দেশে এমন সংগ্রাম ও আত্মত্যাগের উদাহরণ নেই। সে কারণে একুশের চেতনায় এবং এর অন্তর্গত তাৎপর্যে বিশ্বের সব দেশের মানুষই এখন আন্দোলিত হয়, উজ্জীবিত হয়। তারাও নিজেদের মাতৃভাষার মর্যাদা প্রতিষ্ঠা ও রক্ষার তাগিদ ও দায়িত্ব বোধ করে। এখানেই ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলন ও একুশে ফেব্রুয়ারির বিশেষ তাৎপর্য এবং অতুলনীয় সফলতা।

এত বিরাট সফলতা সত্ত্বেও আমাদের কিন্তু গর্ব বা আত্মতৃপ্তি বোধ করার সুযোগ নেই। কারণ, দীর্ঘ ৭২টি বছর পেরিয়ে গেলেও আমরা এখনও বাগাড়ম্বরের মধ্যে সীমাবদ্ধ রয়েছি, বাংলাকে যথাযথ মর্যাদায় প্রতিষ্ঠিত করতে পারিনি। ভাষা আন্দোলনের চেতনায় ভাষা হিসেবে বাংলাকে সমৃদ্ধ করতেও ব্যর্থ হয়েছি আমরা। স্বাধীনতা অর্জনের ৫৩ বছর পরও সমাজ ও রাষ্ট্রীয় জীবনের সবক্ষেত্রে বাংলা ভাষার যথাযথ প্রচলন ঘটেনিÑ যদিও আমাদের সাহিত্য অনেক উন্নতি করেছে, বাংলা ভাষাও কম সমৃদ্ধ হয়নি। তাছাড়া বাংলা চর্চার সৌকর্য বেড়েছে। একই সঙ্গে একথাও আবার স্বীকার করতে হবে যে, সুনির্দিষ্ট এবং সর্বজনগ্রাহ্য একটি বানানরীতি অনুসরণ করার মতো স্তরে এখনো আমরা পৌঁছাতে পারিনি। বহুমাত্রিক অভিধানের অভাবও আমরা কাটিয়ে উঠতে পারিনি। এমনকি বাংলা একাডেমি, জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ড এবং ইসলামিক ফাউন্ডেশনের মতো জাতীয় প্রতিষ্ঠানগুলোও এখনো একই বানানরীতি অনুসরণ করছে না। সংবাদপত্র ও টেলিভিশনসহ গণমাধ্যমের বানান ও উচ্চারণে যেমন শৃংখলা রক্ষা করা হচ্ছে না, তেমনি সর্বোচ্চ আদালতের রায়ও লেখা হচ্ছে ইংরেজিতে। এমন এক বিভ্রান্তিকর পরিস্থিতির কারণে বাংলা ভাষার ক্রম অগ্রগতি ও সুষম বিকাশই শুধু বাধাগ্রস্ত হচ্ছে না, অনেক ক্ষেত্রে বিচ্যুতি পর্যন্ত ঘটছে। 

ওদিকে আধুনিকতা ও আন্তর্জাতিকতার নামে বাধাহীনভাবে চলছে ইংরেজির ব্যাপক চর্চা। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে ভারতের রাষ্ট্রভাষা হিন্দির ব্যবহারও সীমা ছাড়িয়ে গেছে। হিন্দি সিনেমা ও স্যাটেলাইট টিভির কল্যাণে বাংলাদেশের শিশুরা পর্যন্ত আজকাল হিন্দিতে কথা বলছে। হিন্দি ভাষার শুধু নয়, বিজাতীয় সংস্কৃতিরও অনুপ্রবেশ ঘটছে আমাদের পারিবারিক ও সামাজিক জীবনে। একটু ঘুরিয়ে বলা যায়, পাকিস্তান যুগের উর্দুর স্থান দখল করে নিয়েছে হিন্দি ভাষা। বিষয়টি নিয়ে ভাবনার এবং পদক্ষেপ নেয়ার সময় এসেছে অনেকদিন আগেই।

এজন্যই এখন বেশি দরকার হিন্দির আগ্রাসন প্রতিহত করে বাংলা ভাষার মর্যাদাকে সমুন্নত রাখার চেষ্টা চালানো। এ ব্যাপারে রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ পর্যায় থেকে দ্রুত পদক্ষেপ নেয়া দরকার। হিন্দি ও ইংরেজির প্রভাব কমিয়ে আনার পাশাপাশি সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে আমরা বাংলা ভাষার প্রচলন ও প্রতিষ্ঠা দেখতে চাই। তাহলেই সার্থক হবে ভাষা সংগ্রামীদের আত্মত্যাগ। এরমধ্য দিয়ে একুশে ফেব্রুয়ারির মূল চেতনারও বাস্তবায়ন ঘটবে।    

কথাগুলো বলতে হলো, কারণ, রাষ্ট্রভাষা হিসেবে বাংলার স্বীকৃতি আদায় শুধু নয়, ১৯৪৮ থেকে শুরু হওয়া এবং ১৯৫২ সালের ফেব্রুয়ারিতে চূড়ান্ত পরিণতি পাওয়া ভাষা আন্দোলনের সবচেয়ে বড় উদ্দেশ্য ছিল পূর্ব বাংলার তথা পূর্ব পাকিস্তানের ওপর চালানো শোষণ-বঞ্চনার অবসান ঘটানো। পাকিস্তানের পূর্বাঞ্চলীয় প্রদেশ পূর্ব বাংলার তথা বর্তমান বাংলাদেশের জন্য পূর্ণ আঞ্চলিক স্বায়ত্তশাসনের দাবি আদায় করা। এসব দাবির ভিত্তিতে পর্যায়ক্রমিক আন্দোলনের মধ্য দিয়ে আমরা স্বাধীনতা পর্যন্ত অর্জন করেছি সত্য, কিন্তু অর্থনৈতিক মুক্তিসহ আন্দোলনের মূল উদ্দেশ্যগুলো এখনো অর্জন করা সম্ভব হয়নি। 

আমরা অবশ্যই আবারও অতীতের মতো একই পরিস্থিতির শিকার হতে চাই না। আমরা বরং বিশ্বের প্রতিটি ভাষার সুষ্ঠু বিকাশের জন্য চেষ্টা চালানোর পক্ষে। এজন্যই এখন বেশি দরকার হিন্দির আগ্রাসন মোকাবেলা করা এবং বাংলা ভাষার মর্যাদা সমুন্নত রাখার চেষ্টা চালানো। আমরা আশা করতে চাই, এ ব্যাপারে রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ পর্যায় থেকে দ্রুত পদক্ষেপ নেয়া হবে। হিন্দি ও ইংরেজির প্রভাব কমিয়ে আনার পাশাপাশি সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় জীবনের প্রতিটি স্তরে আমরা বাংলা ভাষার প্রচলন ও প্রতিষ্ঠা দেখতে চাই। তাহলেই সার্থক হবে ভাষা সংগ্রামীদের আত্মত্যাগ। এর মধ্য দিয়ে একুশে ফেব্রুয়ারির মূল চেতনারও বাস্তবায়ন ঘটবে। 

অনলাইন আপডেট

আর্কাইভ